Header Ads Widget

Responsive Advertisement

পোশাকশ্রমিকদের মজুরি যৌক্তিক হতে হবে

পোশাকশ্রমিকদের মজুরি যৌক্তিক হতে হবে 




দেশে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। সুতরাং বাজার পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পোশাকশ্রমিকদের এমনিতেই মজুরি বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। তবে এটিই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সঙ্গেও মজুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। কারণ, সামগ্রিকভাবে শ্রম উৎপাদনশীলতা বাড়ছে। তা ছাড়া দেশে গড় আয় বাড়বে আর শ্রমিকদের প্রকৃত আয় বাড়বে না, এটা ন্যায়সংগত নয়। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কালে তৈরি পোশাকশিল্পে শ্রমিকদের অভূতপূর্ব আন্দোলন দেখা গেছে। এই আন্দোলনের মূল দাবি ছিল মজুরি বৃদ্ধি। শ্রমিকেরা ২৩ হাজার ৫০০ টাকার ন্যূনতম মজুরি দাবি করেছেন। পক্ষান্তরে মালিকপক্ষ দিতে রাজি হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ টাকা। 

সর্বশেষ ২০১৮ সালে তৈরি পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা নির্ধারিত হয়েছিল। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল—এই পাঁচ বছর সময়কালে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির (মূল্যস্ফীতি) যোগমূলক পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৬ দশমিক ৬ শতাংশ। সুতরাং, শুধু দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিবেচনাতেই ২০২৩ সালে মজুরির সমমান হওয়ার কথা ১১ হাজার ৭২৯ টাকা। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল—এই পাঁচ বছরে গড় বার্ষিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হার ছিল আনুমানিক ৬ শতাংশ। যদি ধরে নেওয়া হয়, মজুরি নির্ধারণের পরবর্তী বছর এই হার বজায় থাকবে, তাহলে ২০২৬ সাল নাগাদ এই মজুরি হওয়ার কথা ১৩ হাজার ৯৬৯ টাকা। কিন্তু ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষাই মজুরি নির্ধারণের একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সঙ্গেও এটা সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।

সামগ্রিকভাবে দেশের শ্রম উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার প্রমাণ হলো মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি। এই বৃদ্ধির ফলেই বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বর্তমানে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। সুতরাং তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা এই উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কিছু সুফলের ভাগীদার হওয়ার প্রত্যাশা করতেই পারেন। দেশের গড় আয় বৃদ্ধি পাবে আর শ্রমিকদের প্রকৃত আয় বৃদ্ধি পাবে না, এটা ন্যায়সংগত হতে পারে না। 

২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল—এই পাঁচ বছরে বাংলাদেশের গড় আয় যোগমূলকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ। তৈরি পোশাকশিল্পে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হার দেশের গড় উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ ধরে হিসাব করা হলেও ২০২৩ নাগাদ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মজুরি হওয়ার কথা ১৬ হাজার ২১ টাকা। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল—এই সময়কালে বাংলাদেশের গড় আয়ের বার্ষিক বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ। যদি ধরে নেওয়া হয়, মজুরি নির্ধারণের পরবর্তী আলোচনা (নেগোশিয়েশন) পর্যন্ত এই হার বজায় থাকবে, তাহলে ২০২৬ সাল নাগাদ এই মজুরি হওয়ার কথা ২৩ হাজার ৩৫০ টাকা। 

সুতরাং, তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত ১২ হাজার ৫০০ টাকার মজুরি পর্যাপ্ত নয়। এটা ন্যায্যও নয়। কারণ, এই মজুরিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সুফলে শ্রমিকদের কোনো হিস্যা দেওয়া হচ্ছে না। অথচ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে শ্রমিকদের ভূমিকা কম নয়। 

মালিকেরা কি সত্যি মজুরি বাড়াতে পারেন না

ব্যষ্টিক পর্যবেক্ষণ থেকে এখন আমরা বিষয়টিকে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের আলোকে দেখতে পারি। প্রথম প্রশ্ন হলো, আসলেই কি তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের পক্ষে শ্রমিকদের আরও বেশি মজুরি দেওয়া সম্ভব নয়? এই প্রশ্নের বিচারে আমরা দেখতে পারি, এই শিল্পের উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা হয়। ফলে মালিকেরা আয় করেন বৈদেশিক মুদ্রায়, মূলত ডলারে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ডলারের মূল্য ২০১৮ সালের ৮৩ দশমিক ৯০ টাকা থেকে ২০২৩ সালে সরকারি হিসাবেই ১১০ দশমিক ৫০ টাকা হয়েছে, অর্থাৎ ৩১ শতাংশ ৭৭ শতাংশ বেড়েছে। সুতরাং শুধু টাকার দরপতনের কারণেই ২০১৮ সালের ৮ হাজার টাকার পরিবর্তে মালিকেরা ২০২৩ সালে ১০ হাজার ৫৩৬ টাকা দিতে পারেন। 

বিশ্বব্যাংকের একটি লেখায় (ব্লগে) অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন লক্ষ করেছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তৈরি পোশাকের মোট উৎপাদন খরচে মজুরি বাবদ খরচ মাত্র ১ থেকে ৩ শতাংশ। সুতরাং টাকার দরপতনে মালিকদের যে আয়াসহীন বাড়তি লাভ (উইন্ডফল গেইন) হচ্ছে, তা শ্রমিকদের প্রাপ্য অংশের প্রায় ৫০ গুণ। এই বাড়তি লাভ দিয়ে মালিকেরা অনায়াসেই উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে শ্রমিকদের যে হিস্যা প্রাপ্য হয়েছে, তা দিতে পারেন। 

আরও লক্ষণীয়, টাকার দরপতনের প্রবণতা শেষ হয়ে যায়নি। ভবিষ্যতে এই প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে মালিকেরা ভবিষ্যতেও টাকার দরপতনের ফলে আয়াসহীন বাড়তি লাভ পাবেন। কিন্তু শ্রমিকেরা এই লাভের কোনো অংশ পাবেন না। কারণ, এখন যে মজুরি নির্ধারিত হবে, তা মজুরিসংক্রান্ত পরবর্তী আলোচনার আগপর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকবে। সুতরাং বর্তমান মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে টাকার সম্ভাব্য দরপতনের বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। 

বাংলাদেশে মজুরি সর্বনিম্ন

দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো মজুরি বৃদ্ধি পেলে কি বাংলাদেশ তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজার হারাবে? এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, এখনো বিশ্বে বাংলাদেশের মজুরির হার সর্বনিম্ন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সংগৃহীত তথ্যে দেখা যায়, শ্রমিকদের মাসিক মজুরি চীনে ৩০০, ইন্দোনেশিয়ায় ২৪৩, কম্বোডিয়া ২০০, ভারতে ১৭২ এবং ভিয়েতনামে ১৭০ ডলার। অথচ অথচ বাংলাদেশে এই মজুরি মাত্র ৭২ ডলার।

উপড়ে উল্লেখিত ব্লগে জাহিদ হোসেন আরও জানান, মোট উৎপাদন খরচে মজুরির অংশ অত্যন্ত কম হওয়ায় মজুরি যদি দ্বিগুণ করা হয়, সে ক্ষেত্রেও তৈরি পোশাকের খুচরা মূল্য বৃদ্ধি পাবে মাত্র ১ থেকে ৩ শতাংশ। একইভাবে মজুরি যদি তিন গুণ হয়, তাহলেও খুচরা মূল্য বৃদ্ধি পাবে মাত্র ২ থেকে ৬ শতাংশ। এসব পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে মজুরি বৃদ্ধির যথেষ্ট সুযোগ আছে। মালিকেরা অন্যান্য বিষয়ে প্রয়োজনীয় সক্ষমতা দেখাতে পারলে মজুরি বৃদ্ধির কারণে আন্তর্জাতিক বাজার হারানোর আশঙ্কা অমূলক। 

মজুরি নির্ধারণের রাজনৈতিক প্রেক্ষিত 

ওপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মজুরি বৃদ্ধিতে মালিকদের বিরোধিতার মূল উৎস সম্ভবত অর্থনৈতিক বিবেচনা নয়, বরং এর উৎস বহুলাংশে বাংলাদেশে উদ্ভূত সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে নিহিত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সেই অর্থে কোনো পুঁজিপতি শ্রেণি ছিল না। বিগত দশকগুলোতে পুঁজিবাদী ধারার উন্নয়নের ফলে দেশে পুঁজিপতি শ্রেণির আবির্ভাব ঘটেছে। তারা এখন দেশের রাজনীতিতেও নিজেদের প্রভাব–প্রতিপত্তি বাড়িয়েছে। 

এম সাইফুর রহমান কিংবা আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকাকালে দেশের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে সরকারের কিছুটা হলেও ‘আপেক্ষিক স্বাধীনতা’ ছিল। বর্তমানে সেই স্বাধীনতা নেই বললেই চলে। বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহানের এক গবেষণা দেখা গেছে, দেশের একাদশ সংসদে সদস্যদের প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যবসায়ী-শিল্পপতি। মন্ত্রিসভায়ও একই অবস্থা। দেশের রাজনীতিতে এখন পুঁজিপতি শ্রেণির দুই অংশের বিরোধ–আধিপত্য বিরাজ করছে। সেখানে শ্রমিক শ্রেণির কোনো স্বতন্ত্র উপস্থিতি নেই। 

Post a Comment

0 Comments